চলচ্চিত্রশিল্পকে ঘুরে দাড়াতেই হবে

এক প্রজন্মের কাছে ছোটবেলা থেকেই সিনেমা দেখা ছিল জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। বন্ধু-বান্ধব আত্মীয়-স্বজন পাড়াপ্রতিবেশীরা মিলে সিনেমা হলে যাওয়া ছিল জীবনের এক আনন্দঘন মুহুর্ত। বিকেলে সিনেমা দেখার পরিকল্পনা থাকলে সকাল থেকেই মনটা থাকতো উৎফুল্ল। সিনেমা দেখে আসার পর তা নিয়ে সবার সাথে গল্প করাটা ছিল আরো আনন্দের। অন্যরাও মনোযোগ দিয়ে সিনেমাটির গল্প শুনতেন, পেতেন আনন্দ। অভিনেতাদের যে বিষয়গুলো ভাল লাগত তা তাদের জীবনাচরণে অনুকরণের চেষ্টা করতেন। এভাবেই বাঙালীর সাংস্কৃতিক জীবন মিশে ছিল সিনেমার সাথে।

দিনে দিনে জনসংখ্যা যেমন বেড়েছে দর্শকদের চাহিদার ভিত্তিতে তেমনি বেড়েছে হলের সংখ্যা। কেবল বড় বড় বিভাগীয়, জেলা শহরে না, উপজেলা শহরেও সিনেমা হলের সংখ্যা বাড়তে থাকে। কোন কোন উপজেলা যেখানে একটি সিনেমা হল ছিল, সেখানে তিনটি হল নির্মিত হয়। এই ধারা অব্যাহত ছিল আশি ও নব্বই দশক পর্যন্ত, প্রায় সবগুলো সিনেমা হল ব্যবসায়িকভাবে সফল ছিল। দর্শকরা মনমতো ছবি দেখে সন্তষ্ট ছিলেন।
একসময় দেখা যায়, দর্শকরা আর হলে যচ্ছেন না। সিনেমা দেখার প্রবণতা কমতে থাকে। দর্শক সংখ্যা কমে যাওয়ায় হল মালিকরা পুজিঁ বিনিয়োগের টাকা আর তুলতে পারেন না। ফলে তারা বাধ্য হয়ে সিনেমা ব্যবসা বন্ধ করে দেয়। এভাবে সিনেমা হলের সংখ্যা ধীরে ধীরে কমতে থাকে। এক সময় বাংলাদেশে সিনেমা হলের সংখ্যা ছিল ১৬০০’র মত। এখন তা এসে ঠেকেছে মাত্র ৩০০-তে। দর্শকরা হলে যাচ্ছেন না কারণ তাদের শিল্পবোধ ও রুচির সাথে সংগতিপূর্ণ কোন ছবি তৈরি হচ্ছে না। সমসাময়িক ছবিগুলোতে অসংগতিপুর্ণ মারামারি, অশ্লীল নৃত্য, গতানুগতিক অবাস্তব কাহিনী, অনেক সময় অপ্রয়োজনীয় নারীর প্রতি শ্লীলতাহানির দৃশ্য দিয়ে ছবি তৈরি করা হয়। যা অত্যন্ত নিম্নরুচির পরিচয় দেয়। এতে দর্শকরা হতাশ হয়ে হল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র অঙ্গন আর কখনও এর চেয়ে এত খারাপ অবস্থার সম্মুখীন হয়নি।
বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাস মহামারি স্বাস্থ্য আর্থসামাজিক ব্যবস্থায় ব্যাপক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলেছে। আর এর ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রেহাই পায়নি বাংলাদেশের চলচ্চিত্র অঙ্গনও। যে কয়টি হল টিকে আছে তাদের ব্যবসা বন্ধ। প্রযোজকদের ব্যবসা বন্ধ, শুটিং বন্ধ। কলা-কুশলীরা ঘরে বসে আছেন। এ অবস্থায় ক্ষয়িষ্ণু চলচ্চিত্র অঙ্গন আরো হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়েছে।
বিশ্বে চলচিত্রের যাত্রা শুরু হয়, ১৮৯৫্র সালের ২৮ ডিসেম্বর। বানিজ্যিকভাবে ’অ্যারাইভাল অফ এ ট্রেন’ নামে প্রথম ছবি প্রদর্শন করা হয় প্যারিশে। এ ছবিটি ছিল মাত্র ৫০ সেকেন্ডের। অগাস্তে এবং লুই ভ্রাত্বদয় এ ছবিটি নির্মাণ করে। এ ছবিটির দৃশ্য ছিল একটি বাষ্পচালিত ইঞ্জিন সাদা ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে, শব্দ করতে করতে বগিসহ প্যারিশের লা সিওটেট স্টেশনে প্রবেশ করছে। ট্রেনে যাত্রীরা ওঠা-নামা করছে। এ ছবিটি যখন প্রথম করা হয় দর্শকরা বাস্তব জীবনের দেখা ট্রেন, তাদের দিকে এগিয়ে আসছে দেখে চিৎকার করতে করতে হলের পিছন দিকে দৌঁড়াতে থাকে। বাস্তব জীবনে যা দেখেছে এ যেন তারই হুবহু প্রতিফলন। ছবিটি দেখে একজন লেখন বলেন, ’আমি ছবিটি দেখার সময় নির্বাক ছিলাম, আমার বিস্ময় ছিল সমস্ত আবেগ প্রকাশের ঊর্ধ্বে।
ইতিহাসে দেখা যায় চলচ্চিত্র মাধ্যম শুরু হওয়ার পর থেকে সারা বিশ্বে তা ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। বিশ্বে এমন কোন দেশ নেই যেখানে সিনেমা জনপ্রিয়তা অর্জন করেনি। সারাবিশ্বের মত বাংলাদেশেও সিনেমা ব্যাপক জনপ্রিয় ছিল। নির্মিত বিখ্যাত অনেক ছবি, ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ থেকে শুরু করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ওপর। এছাড়া সামাজিক ছবিতো রয়েছেই।
চলচ্চিত্র মাধ্যমের জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ হচ্ছে, গান, সংলাপ, আলোকসজ্জা, শব্দের সংযোজন। ভাষা বিনিময় কাব্যিক ও সরল, প্রাঞ্জল ভাষায়। থাকে কারুকার্য যা ছুঁয়ে যায় দর্শকের হ্দয়। কোন বক্তব্য খুব সহজেই মানুষের কাজে পৌঁছে দেওয়া যায় যা দর্শকের মনের গভীরে অুনুভ’তি সৃষ্টি করে। জীবন সম্পর্কে গভীর উপলব্ধি করার ক্ষমতা তৈরি করে। সমাজে প্রতিনিয়ত কী ঘটছে, সংস্কৃতিভাবে একটি জাতির ভাবনা চিন্তা প্রতিফলিত হয় চলচ্চিত্রে। দর্শক এ থেকে অনেক কিছু শিখতে পারে এবং তা নিজ জীবন গঠনে কাজে লাগাতে পারে। বিশ্বের অনেক নামকরা ছবি তৈরি হয়েছে, যা মানুষকে দুঢ় প্রত্যয়ী ও আত্মবিশ্বাসী করেছে। চলচ্চিত্রের মাধ্যমে যে কোন বিষয় খুব সহজেই উপস্থাপন করা যায় যা দর্শকের আচার আচরণ, রুচিবোধ, জীবদর্শনও পরিবর্তন করে। অনেক সিনেমা আছে যা দর্শকদের দৈনন্দিন জীবনের এক ঘেয়েমি থেকেও মুক্তি দেয়।
অনেক ছবি বিখ্যাত হয়েছে সমাজের অসংগতি তুলে ধরে, সমাজের মানুষের জীবনবোধকে জাগ্রত করে। দেশপ্রেম জাগ্রত করে, মানুষকে ভালোবাসতে শেখায়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এধরনের ছবি তৈরি হয় এবং তা ব্যবসায়িকভাবে সফল হয়েছে। সমাজ জীবনে ঘটে যাওয়া সমস্যা নিয়ে গবেষণামূলক সিনেমা দর্শকের মন স্পর্শ করে। বাংলাদেশেও এধরনের ছবির চাহিদা রয়েছে, কিন্তু তৈরি হচ্ছে না। হাতে গোনা দুএকটি ছবি তৈরি হলেও তা সমাজ জীবনে তেমন ছাপ ফেলতে পারছে না। চলচ্চিত্রের ব্যবসা আর অন্য ব্যবসার মধ্যে পার্থক্য আছে। দুটি ব্যবসা একরকম নয়। চলচ্চিত্রে যারা বিনিয়োগ করবে তাদের অবশ্য দেশপ্রেম থাকতে হবে। মানুষের প্রতি ভালোবাসা থাকতে হবে। সাংস্কৃতিক মানদন্ডে একটি জাতিকে উন্নত শিখরে নিয়ে যাওয়ার ভাবনা থাকতে হবে। এমন মনোভাব নিয়ে বিনিয়োগ করলে অবশ্যই তা ব্যবসায়িকভাবে সফল হবে। দুটি বিষয় বিবেচনা করে ছবি বানালে সাধারণত দর্শকদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়। এক, দর্শকদের রুচি অনুযায়ী ছবি তৈরি করা। দুই, দর্শকদের রুচি, দৃষ্টিভঙ্গি উন্নত করার জন্য ছবি করা।
গুটি কয়েক আর্ট ফিল্ম তৈরি করে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে উপস্থাপন করে এ দেশের ফিল্ম অনেক উন্নত তা দেখানোর কোন সুযোগ নেই। চলচ্চিত্রের অধঃপতিত অবস্থার কারনে সিমেনাপ্রেমিক জনগণ ঘরে বসে ইউটিউব, ইন্টানেট থেকে ছবি দেখে, টিভিতে ছোট পর্দায় নাটক দেখে মনের খোরাক মেটানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু এটা সত্য, হলে বড় পর্দায় ছবি দেখলে মনের গভীরে এক অনন্য অনুভ’তির সৃষ্টি হয়, যা ছোট পর্দায় হয় না। বড় পর্দায় দৃশ্যে পারিপাশ্বিক আমেজ যতটা উপলব্ধি করা যায়, ছোট পর্দায় তা করা যায় না। আর এ কারণেই কোন বিষয় স্পষ্ট করে বোঝানোর জন্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ক্লোজ-সট নেওয়া হয়। কিন্তু বড় পর্দার মত আনন্দ পাওয়া যায় না। তাই সিনেমার বিকল্প সিনেমাই।
বর্তমানে বিনিয়োগকারীদের আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে পাইরেসি। পাইরেসির কারণে বিনিয়োগকারীরা উৎসাহিত হন না। ছবি রিলিজ পাওয়ার সাথে সাথে তা সিডি হয়ে বাজারে বিক্রি হয় অথব ইন্টারনেটে ছেড়ে দেওয়া হয়। এতেও বিনিয়োগকারীরা লোকসানের সম্মুখীন হন। এখানে সরকারের বড় ভ’মিকা রয়েছে। চলচ্চিত্রকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে পাইরেসি আইনের কঠোর প্রয়োগ করতে হবে।
মানুষকে বিনোদিত করতে, সমাজ সচেতন করতে, শিক্ষিত করতে, দেশপ্রেম জাগ্রত করতে, ভালোবাসা শেখাতে যতগুলো মাধ্যম আছে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হচ্ছে চলচ্চিত্র। শিল্পবোদ্ধাদের আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসতে হবে এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে। দেশকে এগিয়ে নেয়ার স্বার্থে।